বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের রপ্তানি খাতকে পরিচয় করিয়ে দিতে সিএনএন ইন্টারন্যাশনাল কমার্শিয়ালের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করেছে বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট (বিএফটিআই)।
নক এলো ইনবক্সে “ভাইয়া, আমাদের নতুন টিভিসি বানিয়েছি । আপনার কাছে জানতে চাই কেমন হয়েছে ?”
এরকম অনুরোধ প্রায়ই আসে । আমিও খুব আগ্রহ নিয়ে কাজগুলো দেখি । না, নিজেকে আমি কোনো পন্ডিত কখনই মনে করি না; বরং শিক্ষানবীশ হিসেবেই ভাবি । তারপরও ইনবক্সে আসা বিভিন্ন ক্যাম্পেইনের ক্রিয়েটিভগুলো দেখি । দেখি কারণ এর মাধ্যমে অনেক কিছু শিখতে পারি, জানতে পারি । বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি-ক্যাটাগরী, নতুন নতুন Consumer insights, নানান ডিরেক্টরের কাজের technic & style, নতুন কিছু পার্সপেক্টিভ বোঝা… আর সাথে সাথে নতুন নতুন গল্প জানার মজাটা তো আছেই – আমার আগ্রহ এসবকিছুতেই ।
যা হোক, টিভিসি দেখতে বসলাম । একবার, দুবার করে বেশ কয়েকবার দেখলাম । কিন্তু কেন, কি উদ্দেশ্যে, কাদের জন্য, কি মেসেজ দিতে এই কাজটি করা সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না । একেকবার একেক অবজেক্টিভ মনে হলো, একেকবার একেক মেসেজ দিচ্ছে বলে মনে হলো ।
এই ব্র্যান্ডের এজেন্সি কারা জানি । পরিচয়ও আছে । যে ফিল্ম ডিরেক্টরের কাজ তাঁর সাথেও চেনাজানা আছে । ভাবলাম একটা পরীক্ষা করেই দেখা যাক । নক্ করলাম এজেন্সীকে । জিজ্ঞাসা করলাম এই ক্যাম্পেইনের Objective কি ? এই টিভিসি’র Core message delivery কি ? উনারা উনাদের উত্তর দিলেন । এবার নক্ করলাম ফিল্ম ডিরেক্টরকে । জিজ্ঞাসা করলাম একই কথা ।
উনার উত্তরও নোট করে নিলাম । এবার সবশেষে নক করলাম ব্র্যান্ড পার্সনকে । একই জিনিষ জানতে চাইলাম । সেও উত্তর দিল বেশ বুঝিয়ে । ৩ জনের উত্তর শুনে গোলযোগটা কোথায় কিছুটা আঁচ করতে পারলাম ।
নিশ্চিত হবার জন্য ব্র্যান্ড পার্সন কে বললাম “এই ক্যাম্পেইনের ব্রিফটা আমাকে পাঠাতে পারবেন ?” তিনি বললেন “ভাইয়া, এটার তো ব্রিফ ছিল না ।” “ব্রিফ ছাড়া ক্যাম্পেইন নামাচ্ছেন কি করে ?!? এই টিভিসি-ই বা বানালেন কিভাবে ?” এইবার অবাক আমার প্রশ্ন ! “একজন গল্পটা শেয়ার করেছিল । ভাল লেগেছে । বানিয়ে ফেললাম ।” গোলযোগ এবং তার মূল কারণটার ব্যাপারে এবার আমি নিশ্চিত হলাম ! গোলযোগটা কি ? বলছি । তবে তার আগে একটা প্রশ্ন করি ।
কোনোদিন কি এমন হয়েছে যে আপনি কোনো একটা আইডিয়া নিয়ে চিন্তা করছেন, আর আপনার পাশের আরেকজন আপনি মুখে না বললেও সেই আইডিয়াটি হুবহু বুঝে ফেলেছে ? তাকে আপনার চিন্তা-ভাবনা-আইডিয়াখানা বোঝাতে কোনো কথাই খরচ করতে হয়নি ! সে যাকে বলে ‘মাইন্ড-রিডার’ আর কি ! হয়েছে এমন কখনও ? নিশ্চয়ই হয়নি । হওয়া সম্ভবও নয় । সায়েন্স ফিকশন কিংবা মুভিতে এমন দেখালেও তা বাস্তবে যে তা সম্ভব নয় সেটি বলাই বাহুল্য ।
তবে আপনি কিভাবে আশা করছেন যে আপনার এজেন্সী পার্টনারকে ঠিকঠাক মত না জানালেও তাঁরা ঠিকই বুঝে যাবেন যে আপনার মনের ভেতর কি চলছে ?!? ক্যাম্পেইন থেকে আপনি ঠিক কি চান? কিভাবে চান ? কখন চান ? কতটুকু চান ?
আমার কাছে মনে হয় ‘Campaign brief’ মার্কেটিং ওয়ার্ক প্রসেসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ৩ টি জিনিষের মধ্যে একটি । মজার কথা হলো আমার অবজার্ভেশন বলে মার্কেটিয়ারগণ সাধারণ সবচেয়ে বেশী যে ৩ টি জিনিষ এড়িয়ে চলেন এই ‘Campaign brief’ই আবার তার ভেতর একটি !
Brief লিখতে আমাদের ভীষন অনিচ্ছা ! ভীষণ অনিহা !! ভীষণ সময়ের অভাব !!! অথচ, যেকোনো মার্কেটিং ক্যাম্পেইনের সবচেয়ে প্রথম স্টেপ হলো ‘Brief’ । ঠিকঠাক, টু-দি-পয়েন্ট, পরিষ্কার একখানা Brief !
যে কোন মার্কেটিং ক্যাম্পেইনে অনেকগুলো পক্ষ জড়িত থাকে – both Internal and External । Internal পক্ষগুলোর ভেতর থাকে অতি অবশ্যই মার্কেটিং টিম, মিডিয়া টিম, ফাইনান্স টিম, কখনও কখনও সাপ্লাই-চেইন টিমও । আর External পক্ষগুলোর মধ্যে থাকে স্ট্র্যাটেজিক ও ক্রিয়েটিভ এজেন্সি, মিডিয়া এজেন্সি, ক্রিয়েটিভ প্রোডাকশন টিম, কখনও কখনও রিসার্চ এবং এ্যাক্টিভেশন এজেন্সিও ।
প্রশ্ন হলো এতগুলো পক্ষকে একসাথে align করবেন কিভাবে ? আপনার চিন্তা-আইডিয়া-লক্ষ্যকে কিভাবে তাঁদের সবাইকে ঠিকঠাক মত বোঝাবেন ? ব্রিফ হচ্ছে সেই জাদুর কাঠিটি ! এটি এমন একটি ডকুমেন্ট যেটি ক্যাম্পেইনের সাথে জড়িত সকল পক্ষকে একসাথে গাঁথতে পারে । প্রত্যেকের Expectation, Timing, Target,, Deliverables একসাথে aligned করতে পারে ।
সহজ কথায় বলতে গেলে ব্রিফে থাকে একটি ক্যাম্পেইনের গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর –
তার সাথে আরও থাকে – আপনার ব্র্যান্ডের টেরিটরী, পার্সোনালিটি, ক্যাম্পেইন সম্পর্কিত কনজ্যুমার ইনসাইট এবং প্রোডাক্ট/সার্ভিসের benefit offerings ইত্যাদি অত্যন্ত ক্রিটিক্যাল সব তথ্য ।
এবার বুঝে দেখুন ‘ক্যাম্পেইন ব্রিফ’ টি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ! এহেন মহা গুরুত্বপূর্ন স্টেপটি বাদ দিয়েই আপনি যখন ক্যাম্পেইন করতে নেমে পড়েন তখন বেশ কয়েকটি জটিলতা দেখা দেয় ।
প্রথম জটিলতা বাঁধে ব্র্যান্ড টিম আর এজেন্সীর মধ্যে । ব্র্যান্ড টিমের মাথায় পুরো ক্যাম্পেইন নিয়ে অবজেকটিভ, আইডিয়া, এক্সপেক্টেশন থাকে এক রকম । কিন্তু যেহেতু সে এজেন্সি পার্টনারকে ঠিকঠাক মত ব্রিফ দেয়নি, সুতরাং এজেন্সি টিমের মাথায় ক্যাম্পেইন নিয়ে অবজেকটিভ, আইডিয়া, ডেলিভারেবল কাজ করে আরেক রকম । এই গড়মিল হবারই কথা । এজেন্সী টিম তো মাইন্ড রিডার নন, যে তাঁরা না বললেও ব্র্যান্ড টিমের মনের কথা বুঝে ফেলবেন !
পরের জটিলতা বাঁধে ক্রিয়েটিভ টিমের সাথে । পরিষ্কার ব্রিফ না থাকায় ক্রিয়েটিভ টিম আইডিয়ার ইন্টারপ্রিটেশন করেন তাঁদের ইচ্ছামত ! যার ফলে পুরো ক্রিয়েটিভ রেন্ডিশন (Creative rendition)-টা যে উদ্দেশ্য সামনে রেখে ক্যাম্পেইন করার কথা, তার থেকে বহু দূরে চলে যায় । ব্র্যান্ড ম্যানেজার সেটি ঠিকমত বিচারও করতে পারেন না, কারণ বিচার করবেন কিসের বিপরীতে ? যেই ব্রিফে থাকার কথা ছিল ক্রিয়েটিভ আইডিয়া বিচার করার মাপকাঠি, সেই ব্রিফই তো তৈরী করা হয় নি । সুতরাং, ব্র্যান্ড ম্যানেজার খুব বেশী হলে আমতা আমতা করে বলতে থাকেন “উম, খুব বেশী ভাল লাগে নি ।” কিন্তু কি ভাল লাগেনি, কেন ভাল লাগেনি, কি করলে ভাল লাগবে – সেটি বলার সাধ্য তাঁর থাকে না । সুতরাং, এজেন্সীও খুজে পায়না কোথায় সমস্যা ! একসময় টাইম প্রেশারে সেই ‘ভাল-না-লাগা’ ক্রিয়েটিভখানাই ব্যবহার করা শুরু করতে হয় । আর এই ভজঘটের অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হিসেবে আপনি আপনার কনজ্যুমারকে যে মেসেজ দিবেন বলে পুরো ক্যাম্পেইনটা করছেন, কনজ্যুমার সেই মেসেজ তো পায়ই না । বরং উল্টো এমন মেসেজ তাঁদেরকে দেয়া হয়, যেটি হয় অপ্রয়োজনীয়, না হয় ভুল ! এবার চিন্তা করে দেখুন শুধু মাত্র একটা ঠিকঠাক ব্রিফ না দেবার জন্য পুরো সময়-পরিশ্রম এবং টাকাটা জলে তো গেলই, বরং উল্টো ব্র্যান্ডের ক্ষতি করা হল ! কি ভয়াবহ ব্যপার !!
এর পরের আঘাতটা আসে সরাসরি ব্র্যান্ড টিমের উপর ! যেহেতু ক্যাম্পেইনের ব্রিফ নেই, সুতরাং ব্র্যান্ড টিমের হাতে Clear cut এবং সব ফাংশনের সাথে Agreed success definition নেই । কি হলে বোঝে যাবে ক্যাম্পেইন সফল, আর কি হলে বোঝা যাবে যে ব্যর্থ – তাও সে বুঝতে পারে না । ব্র্যান্ড ম্যানেজার যখন ক্যাম্পেইনের ভিউ বা ভাইরালিটি নিয়ে খুশীতে বগল বাজাচ্ছেন, সেলস টিম হয়তো তখন বিরক্ত হয়ে বসে আছে ক্যাম্পেইনের কোনো প্রভাব তার সেলসে আসছে না দেখে ! আর ফিন্যান্স টিম হয় ভ্রু কুঁচকে ভাবছে এত টাকা খরচ করে লাভটা কি হলো – ক্যাম্পেইনের ROI (Return on Investment) তো নেগেটিভ ! যত্তসব পয়সা নষ্ট !
ফলাফল মিটিং এ হাউকাউ । এবং সবশেষে ব্র্যান্ড টিমের উপর ম্যানেজমেন্টের প্রেশার ! এই প্রেশারে দু-একজনের চাকরী নিয়ে টানাটানি পরলেও অবাক হবার কিছু নেই । ম্যানেজমেন্টকে আপনি তাতে দোষও দিতে পারেন না । কারণ, তাঁদেরকে আপনি এক সুতায় গাঁথতে পারেন নি যে কি হলে ক্যাম্পেইন সাকসেস বোঝা যাবে, আর কি হলে বোঝা যাবে ফেইল । সুতরাং, একেকজন ভেবেছেন একেকভাবে ! আর Align করবেনই বা কিভাবে আপনি তো ব্রিফই তৈরী করেন নি, যেখানে এগুলো লেখা থাকে !
কিন্তু আমরা ঠিকঠাক ব্রিফ লেখি না কেন ?
আমার অবজার্ভেশন কয়েকটি কারণ বলে –
কারণ যাই হোক, আপনার গোড়াতে যখন গলদ রয়ে যাচ্ছে তখন ফলাফলও হয় ঐরকমই । লেখার শুরুতে বলা ঘটনার মত – আপনার এজেন্সীর মাথায় অবজেকটিভ-মেসেজ থাকে এক রকম; আপনার ক্রিয়েটিভ টিমের মাথায় অবজেকটিভ-মেসেজ থাকে আরেকরকম, আর আপনার মাথায় অবজেকটিভ-মেসেজ থাকে আরেকরকম ! সুতরাং, ক্রিয়েটিভ তৈরী হয় অনেকটা শীতকালের সব্জী-খিচুরীর মত – চাল, ডাল, শীতের যাবতীয় সব্জী – সওব থাকে । যার যেটা ইচ্ছা খেয়ে মজা পাক । প্রশ্ন হচ্ছে আপনার কনজ্যুমার এই খিচুরীর কোন অংশটি খাবেন, অর্থাৎ কোন মেসেজটি interpret করবে ? সেটি তখন যাকে বলে লটারী জেতার মত ব্যপার – “যদি লাইগা যায়” ! তবে কখনই সবসময় সেটি ‘লাইগা যায় না’ । আর তখন আপনাকে চাকরী বাঁচানোর জন্য জায়নামাজে বসে দোয়া করা ছাড়া কোনো পথ থাকে না ।
Writer – Galib Bin Mohammad